একজন বীরাঙ্গনা জননী 

নিরঞ্জন মন্ডল, রামপাল, বাগেরহাট, 

চট্টলা কন্যা একাত্তরের বীরাঙ্গনা জননী 

           রমা চৌধুরী  

তোমাকে জানাই পুষ্পিত অভিবাদন।

 এতদিন তোমার নগ্ন পায়ের পাতায় চোখ রেখে অনুভব করেছি, একটি নতুন দেশের জন্ম যন্ত্রনা ।

এক সচ্ছল সম্পন্ন সুখি পরিবারে নান্দনিক দাম্পত্য জীবন ছিল তোমার। 

 কালের বিবর্তনে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে কোপাদিয়ায় তোমার সেই যাপিত জীবন হানাদার বাহিনী গান পাউডার ছিটিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে তোমার ভিটে মাটি এবং স্বপ্নের বসতি। 

যে লজ্জার রঙ রক্তের মতো লাল, সন্তানদের সামনে, একাত্তরে তা কেড়ে নিয়েছে হানাদার বাহিনী । জীবন সায়াহ্নে তোমার মাথা গোঁজবার ঠাঁই টুকু ও ছিল না। লজ্জা নিজেই লজ্জিত হয়েছে তোমার কাছে।

জাতপাতের দগদগে ঘা থেকে দুর্গন্ধ

মেখে নিয়ে,যারা তোমার বাসস্থান পুড়িয়ে দিয়েছে, তোমার পবিত্র মন্দির ভেঙ্গে ফেলেছে, ঘৃণা ভরে তোমাকে গালি দিয়েছে, তোমার পবিত্র শরীর মন কলুষিত করেছে, তোমার জননী অহঙ্কারকে পদদলিত করেছে-কারো কাছে অভিযোগ না জানিয়ে, মনে মনে ধিক্কার জানিয়েছো তাদের মনুষ্য জন্মকে।

 বীরাঙ্গনা জননী তুমি, জ্বলন্ত আগুনে পুড়তে পুড়তে বেঁচে থেকেছো সংসার নামক শ্মশানে। চোখের জলের প্রথম ফোটাটি মাটি ছোঁবার আগেই, চেতনার সহস্র শিখায় জ্বলে উঠেছো দাবানল হয়ে। 

প্রতিজ্ঞার কঠিন দৃঢ়তায়, আলোড়িত করেছো নিরন্তর সুখে-দুখে সংগ্রামে ।

তাইতো তোমাকে অভিবাদন জানাই ভক্তিতে, শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়….

‘বাঙালীয়ানা’ নামক এক গভীর জীবন বোধে নিবেদিত থেকেছো সারা জীবন।  

এ মাটি জানে, তোমার মত অসংখ্য সূর্য সন্তানের বুকের রক্তে, গোপন লজ্জায়,

 সন্তান হারানোর বেদনায়,বৈধব্যের যন্ত্রনায়, অসীম দুঃখ কষ্টে, আত্মত্যাগে এ দেশ শত্রুমুক্ত হয়েছে।

বীরাঙ্গনা জননী রমা চৌধুরী, তোমাকে চর্ম- চক্ষে দেখবার প্রয়োজন পড়ে না, হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করা যায় তোমার গভীর মর্মবেদনা আর তীব্র হাহাকার।

জীবন সায়াহ্নে, কঠিন দারিদ্র্যের মধ্যে ও তুমি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হৃদয়ে ধারণ করে, স্বরচিত সৃষ্টিমালা হাতে, হেঁটে হেঁটে পৌঁছে গেছো মানুষের দুয়ারে।

তোমাকে বেরুতে হয়েছে রৌদ্রজ্জ্বল দুপুরে, বৃষ্টি স্নাত সকালে, কাঠফাঁটা রোদ্দুরে। জীবিকার টানে, জীবনের প্রয়োজনে স্বরচিত কথামালা বিক্রির টাকায় জোটাতে হয়েছে অন্ন। জলে জঙ্গলে,ধূলি ধূসরিত পথে,পাহাড়ি নদীর পার ধরে…. আমৃত্যু নগ্ন পায়ে হেঁটে হেঁটে বিক্রি করেছো স্বরচিত জীবন বেদনা।

বলেছো : যে মাটিতে আমার সন্তানের রক্ত ঝরেছে, আমি জুতা পায়ে কী করে সেই মাটি মাড়িয়ে যাবো ?

লজ্জা হারানো লজ্জায়, প্রতি ডিসেম্বরে তুমি কেঁদে কেঁদে গোপনে বুক ভাসিয়েছো, অভিমানে আসোনি জনসম্মুখে। দেখেছো, এদেশের মাটিতে ধর্ষকেরা এখনো বুক উঁচিয়ে হাঁটে, হুঙ্কার ছাড়ে পাকিস্তানি আদর্শে ফিরে যাবার।

 আদর্শিক দুঃসাহসে, একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার মতো, আত্মসম্মান না বিকিয়ে, বিনীত ভাবে ফিরিয়ে দিয়েছো প্রধান মন্ত্রীর সাহায্য প্রস্তাব।

তুমি শুধু বীরাঙ্গনা নও, তুমি মুক্তিযোদ্ধা, আদর্শ লেখিকা। এদেশ তোমার কাছ থেকে পেয়েছে অনেক কিছুই, কিন্তু দেয়নি কিছুই, তাইতো – শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় তোমার স্মৃতির প্রতি নিবেদিত আমার এ পংক্তিমালা

বড় কষ্ট বুকে নিয়ে, স্বর্গ পথের আগুন রথে, চেতনা ভস্ম হয়ে মিশে আছো তুমি বোয়ালিয়ার পাথুরে মাটিতে, তোমার মায়াবী মুখের প্রতিবিম্ব আজো প্রতিদিন ছায়া ফেলে বাঙালির হৃদয়

আয়নায়।

6 thoughts on “একজন বীরাঙ্গনা জননী ”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *