গল্প: সাঁকো

                লেখক: কিশোর পন্ডিত, জেলা: টাঙ্গাইল। পেশা: শিক্ষক কবি ও কথাসাহিত্যিক

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পর দেশ যেন উত্তাল হয়ে উঠল। সবার চোখে মুখে যেন জিঘাংসার আগুন। সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য। ১৯৭১ সাল। মার্চ মাস। চারিদিকে মিছিল আর মিছিল। মিছিলে নানা স্লোগান- “তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা”।” তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব”। শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধ। টাঙ্গাইলের বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গড়ে উঠলো কাদেরিয়া বাহিনী। যুদ্ধের শুরুতেই এই বাহিনী রায়পুর গ্রামের রায়খালী নদীর উপর নির্মিত ব্রীজ আগে ধ্বংস করল এই গ্রামকে রক্ষা করার জন্য। এমনই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দিনে রায়পুর উত্তর পাড়ার রমেশ দাসের বাড়ি তার মেয়ে পার্বতী ও নাতনি বিজয়া এসেছে। তার মেয়ের বাড়ি মধুপুরের সেনবাড়ি গ্রামে । সে গ্রামে নাকি মিলিটারির অত্যাচার ঢের বেড়েছে । রমেশ দাস তাই তাদের ভয়ে ভরা যৌবনা মেয়ে পার্বতী ও স্পর্শ যৌবনা নাতনি বিজয়াকে তার নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছে। রায়খালী ব্রিজ মুক্তিযোদ্ধারা ভাঙ্গার পর রায়পুর গ্রামটা মোটামুটি নিরাপদ আছে। রায়পুর‌ গ্রামের পিচ কমিটির চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম গ্রামের পুরুষদের ডেকে বিভিন্ন কায়দায় বুঝাতে চেয়েছেন যে শেখ সাব মুসলমানদের দুশমন , ভারতীয় দালাল তিনি তাদের সাথে যোগ দিয়ে আমাদের এই দেশটাকে তাদের হাতে তুলে দিতে চায়। আমরা কোনভাবেই তা মেনে নিতে পারি না।‌ তাই আমাদের ভাই পাকিস্তানিদের পক্ষে আমাদের লড়তে হবে। তার কথায় সারা দিয়ে অনেক যুবক রাজাকারে যোগ দিয়েছে। সালাম সাহেব ইজ্জত আলীকে তাদের সাথে কাজ করতে বললে ইজ্জত আলী তাদের অনুপ্রেরণায় তাদের সাথে কাজ করবে বলে ভাবছিলো। একদিন সালাম সাহেব সবার উদ্দেশ্যে বললেন মুক্তিযোদ্ধারা রায়খালীর ব্রিজ ভাঙ্গাতে আমাদের দোস্তরা এ গ্রামে আসতে পারছেন না। আমাদের শত্রু মুক্তিযোদ্ধারা এ গ্রামে অবাধে তাদের কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে ‌ । চলো আমরা সবাই মিলে রায়খালী নদীর উপর একটা সাঁকো বানিয়ে দেই। ওস্তাদের কথা মত সবাই সকল সরঞ্জাম বাঁশ, কাঠ ইত্যাদ দিয়ে একটা সাঁকো তৈরি করল। ইজ্জত আলীও এ কাজে সাহায্য করলো।

 ২৫ বছরের যুবক ইজ্জত আলীর কেন জানি পার্বতীকে ভালো লাগে। তার চোখ শুধু পার্বতীকে দেখতে চায়। তাকে দেখলে তার মন কেমন যেন করে। সামনে আসলেই ধক করে বুক কেঁপে উঠে। কেন যে এমন হয় সে বোঝেনা। পার্বতী কিন্তু তার চেয়ে ৫/৬ বছরের বড়। একদিন জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ দুপুর। উত্তর আকাশে ঘন মেঘ করেছে। ঝড়- বৃষ্টি আসার সম্ভাবনা রয়েছে। পার্বতীদের বাড়ির রাস্তা দিয়েই সে এক ঝাঁকা কলা বিক্রি করবার জন্য হাটে নিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ খবর পেল গ্রামে মিলিটারি ঢুকেছে। হাটে অনেক লোককে হত্যা করেছে। সামনে তাকাতেই কিছু দূরে লক্ষ্য করল কালু রাজাকার পাঁচজন মিলিটারি সাথে নিয়ে রমেশ কাকাদের বাড়ির দিকে আসছে। ইজ্জত আলী সামনে অগ্রসর না হয়ে বাড়ির পিছনে পাট ক্ষেতে ঢুকে পালিয়ে রইল। কালু রাজাকার দর দর করে রমেশ দাসের বাড়িতে ঢুকে পড়ল। মিলিটারির ভয়ে গ্রাম প্রায় মানুষ শুন্য। ওই বাড়িতে শুধু পার্বতী ও তার কন্যা বিজয়া ছিল। রাজাকার পার্বতীকে দেখিয়ে দিয়ে ঘরের পিছনে ঠায় দাঁড়িয়ে বাইরের পাঠখড়ির বেড়া দুই হাতে ফাঁক করে ক্যামেরার ন্যায় চক্ষু স্থির করে যেন ফটো তুলতে লাগলো। রাজাকার দেখল মিলিটারিরা পার্বতীকে শকুনের মত ঘিরে ধরেছে। দুইজনে তার কন্যা বিজয়াকেউ টার্গেট করলো। বিজয়াকে টেনে হিঁচড়ে ঘরের বারান্দায় জল চকির উপর শুইয়ে দিল। পার্বতী সকল দেখে সকল বুঝে সম্মোহিনী পতিতার মত অন্তর্বাস খুলে পরনের বস্ত্র খানা হাঁটুর উপর তুলে অর্ধ নগ্ন হয়ে যেন বিশ্ব বেহায়া দেহ প্রসারিনির ন্যায় চক্ষু বাঁকিয়ে বারবার ইশারা দিল যেন তারা সকলেই তার নগ্ন দেহ ও ভরা যৌবনে আকৃষ্ট হয়ে তার ডাকে সারা দিয়ে তার ছোট অবুঝ মেয়েটাকে রেহাই দেয়। কিন্তু নরপিশাচ দেহভোগিরা মা মেয়ে উভয়কেই ভোগ করার অভিপ্রায়ে কাম আসক্ত কুকুরের ন্যায় নারী যুগলের সামনে দেহ ভোগের আনন্দে কামুক নৃত্য করতে লাগল। বারান্দা থেকে বিজয়া চিৎকার করল মা আমাকে বাঁচাও, ওরা যেন আমার পেটের ভিতর কি ঢুকিয়ে দিল। পার্বতী তার মেয়ের এই চিৎকার শুনে করালগ্রাসী রণচন্ডী মূর্তি ধারণ করে হায়েনাদের কারো হাতে কামড় আবার জ্ঞান শূন্য হয়ে কারো বুকে লাথি মেরে ছুটে গিয়ে মেয়েকে বাঁচাতে উদ্যত হলো। হঠাৎ নর পিশাচদের কেউ একজন পিছন হতে পার্বতীর দেহে বেয়নেটের আঘাত করল। এতে পার্বতীর অস্থিমজ্জার ব্যথা হলো ঠিকই কিন্তু প্রাণের ব্যথা কিছুই হলো না। সে গায়ে আরো জোর এনে সামনে অগ্রসর হল । ততক্ষণে ওদের কেউ রাইফেলের দু’খানা গুলি ছুড়ে মারলো। একখানা গুলি পার্বতীর বুক চিরে প্রাণে আঘাত করল অন্য খানা শো করে পিছনের পাট ক্ষেতে ঢুকে গেল। পার্বতীর দেহ খানা কলা গাছের মতো ঠাস করে উঠোনে পড়ে গেল। দ্বিতীয় গুলি পাট ক্ষেতে লুকিয়ে থাকা ইজ্জত আলীর মাথায় না লেগে ঝাঁকায় লেগে ঝাঁকা উড়ে গেল। ইজ্জত আলী প্রাণে বেঁচে গেল। ততক্ষণে কাদেরিয়া বাহিনী খবর পেয়ে গ্রাম বাঁচাতে তুমুল যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে। যুদ্ধের রসদ এবং সৈনিক কম থাকায় মিলিটারিরা প্রাণ বাঁচাতে কাপুরুষের মতো পালিয়ে ক্যাম্পে আশ্রয় নিলো।

 এবার ইজ্জত আলী ধীরে ধীরে ও ভয়ে ভয়ে বাড়িতে কি ঘটলো দেখার জন্য বাড়িতে প্রবেশ করল । ইজ্জত আলী দেখল যা ভেবেছিল তাই ঘটেছে। কিন্তু পার্বতীর কন্যা বিজয়ার দিকে তাকিয়ে যা দেখল তা ভাবে নাই। ইজ্জত আলী দেখল পার্বতীর প্রাইমারি পড়ুয়া ১০ বছরের কন্যা বিজয়া তার মায়ের নিকট দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার খাটো ফ্রক খানা গায়ে রয়েছে কিন্তু পরনের ঘটি হাফপ্যান্ট খানা দূরে পরে রয়েছে। তার দুই উরু বেয়ে গোপনাঙ্গের রক্ত পা গড়িয়ে মাটিতে মিশেছে। কন্যার জরায়ুর রক্ত আর মায়ের বুকের রক্ত মিশে একাকার হয়ে গেছে। রক্তের লাল রং দেখে বোঝা গেল না কোনটা মেয়ের আর কোনটা মায়ের রক্ত। ইজ্জত আলীর টনক নড়লো। সালাম সাহেব আমাকে ওদের সাথে যুদ্ধ করতে বলেছিল,আমি বর্বরদের যুদ্ধের সাথী হতাম । একটা সাঁকো যেমন জলাশয়ের দুই পাড়ের সংযোগ করে দেয় রাজাকারেরাও তেমনি মিলিটারিদের খবর এবং গোপন তথ্য দিয়ে গ্রামের সাথে সংযোগ স্থাপন করছে। তারা এখন পাকিস্তানিদের সাঁকো। ইজ্জত আলী ঠিক করল রাইখালীর যে সাঁকো দিয়ে মিলিটারিরা এসেছিল সেই সাঁকো আগে ভাঙতে হবে,পরে মিলিটারিদের হত্যা করতে না পারলেও কালু রাজাকারদের বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। ইজ্জত আলী ভাবল ভিনদেশী পাষন্ডেরা দেশের যে ক্ষতি করছে তার চেয়ে অধিক ক্ষতি করছে নিজ দেশীয় বর্বর রাজাকারেরা । পাক সৈনিকের অত্যাচারে প্রাণ গেলেও মান রক্ষা পেত। প্রাণ তাদের হাতে গেলেও রাজাকারের কারণে তাদের সাহায্য সহযোগিতায় প্রাণ ও মান উভয়ই যাচ্ছে। তাই মান রক্ষার্থে মিলিটারি হত্যার চেয়ে বেশি নিধন করতে হবে রাজাকারদের। ইজ্জত আলী তার প্রতিজ্ঞা মতে রাতের অন্ধকারে রাইখালীর সাঁকো খানা ভাঙলো, পরে সে দু’জন রাজাকারকে হত্যা করল। এক: কালু রাজাকার দুই: ইজ্জত আলী রাজাকার। ইজ্জত আলী রাজাকারকে হত্যা করে সে নিজেকে ইজ্জত আলী মুক্তিযোদ্ধা আবিষ্কার করল। ইজ্জত আলী ভবিষ্যৎ ভাবনায় ভাবল যদি দেশ স্বাধীন হয় তবে কি এই রাজাকারেরা এই স্বাধীন দেশে নির্লজ্জ বসবাসের কাপুরুষিত সাহস দেখাবে ? স্বাধীনতার অপেক্ষায় রইলো ইজ্জত আলী। মনে মনে ভাবল দেখি এত জান ও মানের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা আমাদের কি দেয়।

                                সমাপ্ত।

গল্পের নাম : সাঁকো 

লেখকের নাম : কিশোর পণ্ডিত

1,132 thoughts on “গল্প: সাঁকো”

Comments are closed.